আত্মহত্যা মানবমৃত্যুর দশটি প্রধান কারণের একটি। দুর্ঘটনা এবং হত্যাকাণ্ডজনিত মৃত্যুর পরে, ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। আত্মহত্যার কারণ বহুবিধ এবং জটিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রতিরোধযোগ্য।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যায়। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার ৭.৩ প্রতি লাখে প্রতি বছর। ১৩-১৭ বছরের কিশোরদের প্রতি ১০০ জনে ৪ জন এবং কিশোরীদের প্রতি ১০০ জনে ৬ জন আত্মহত্যা করার চিন্তা করে। আত্মহত্যার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে বা চিন্তা করে।
যাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা আছে তারা অনেক ক্ষেত্রে নিচের আচরণগুলি দেখাতে পারে –
- মরে যাওয়ার কথা বলে বা কেউ মেরে ফেললে ভাল হতো বলে মত প্রকাশ করে।
- প্রায়ই শূন্যতা, হতাশার কথা বলে বা বলে বেঁচে থাকার কোন কারণ বা মানে নেই।
- আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে বা নিজেকে মেরে ফেলার উপায় খুঁজে। যেমন- ইন্টারনেটে আত্মহত্যার উপায় খোঁজা, ওষুধ জমানো।
- বড়ধরণের অপরাধবোধ, অপমান, গ্লানি অনুভব করা।
- এমন মনে করা যে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই বা এই সমস্যার কোন সমাধান নেই।
- অবর্ণনীয়, অসহ্য মানসিক বা শারীরিক কষ্ট অনুভব করা।
- নিজেকে অন্যদের বোঝা মনে করা বা বোঝা বলে বর্ণনা দেয়া।
- ঘন ঘন মাদক গ্রহণ করা।
- উৎকণ্ঠিত, উত্তেজিত বা বিচলিত আচরণ করা।
- পরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া।
- ঘুম এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হওয়া।
- ক্রোধ প্রকাশ করা বা প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলা।
- মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারে। যেমন- খুব জোরে বাইক চালান।
- ঘনঘন মৃত্যুর কথা বলা বা চিন্তা করা।
- মেজাজের ঘনঘন পরিবর্তন দেখান। যেমন- মুহূর্তের মধ্যে খুব বিমর্ষ অবস্থা থেকে শান্ত বা উৎফুল্ল দেখান।
- নিজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিষপত্র বা সম্পত্তি দিয়ে দেয়া।
- পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবদের বিদায়সূচক কথা-বার্তা বলা।
- সব কাজ গুছিয়ে নেয়া, সম্পত্তি বিলিবণ্টনের জন্য দানপত্র লেখা।
যদি এই বিপদ সংকেতগুলি আপনার ক্ষেত্রে বা আপনার পরিচিত কার জন্য প্রযোজ্য হয়, যত দ্রুত সম্ভব সাহায্য নিন, বিশেষ করে যদি আচরণগুলি নতুন হয় বা সম্প্রতি বেড়েছে।
আত্মহত্যার কারণ বহুবিধ এবং জটিল, কোন একটি নির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিত করা কঠিন। অনেকগুলি বিভিন্নধরণের ঝুঁকি একসাথে যুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। যারা আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আত্মহত্যার পেছনে প্রধান ঝুঁকিগুলি হচ্ছে –
- বিষণ্ণতা রোগ
- ব্যক্তিত্বের সমস্যাজনিত রোগ
- মাদকাসক্তি
- নিজেকে আঘাত করা, যেমন- শরীরে কাটাকাটি করার প্রবণতা
- পূর্বে আত্মহত্যা চেষ্টার ইতিহাস
- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক রোগ বা মাদকাসক্তির ইতিহাস
- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার ইতিহাস
- পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস
- পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, বিখ্যাত ব্যক্তি, মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের আত্মহত্যা প্রত্যক্ষ করা বা এ সম্পর্কে জানা।
সংক্ষিপ্ত চিকিৎসা
সুরক্ষা পরিকল্পনাঃ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য এবং কাছের মানুষদের সাথে কথা বলে একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনার মধ্যে থাকে, তার কাছ থেকে আত্মহত্যার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে এমন ওষুধ, ধারালো জিনিষ, অস্ত্র, বিষ ইত্যাদি সরিয়ে রাখা। তাকে ঝুঁকি থাকা অবস্থায় একা থাকতে না দেয়া। তার সাথে নিয়মিত কথা বলা, সাহায্য করা এবং ভালবাসা দেখান। যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে, সেক্ষেত্রে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি, আত্মীয়, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, বন্ধু-বান্ধব বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করা। এছাড়া কোন চাপ বা ঘটনা থেকে আত্মহত্যাপ্রবণতা শুরু হলে, তা সমাধানে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করা।
ফোন কলঃ আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলে, তাকে সাধারণত কিছুদিন অন্তর অন্তর ফোন কল দেয়া হয়। ফোন কলে তার আত্মহত্যা ঝুঁকির তীব্রতা এবং মানসিক অবস্থা যাচাই করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। দেখা গেছে যারা নিয়মিত ফলো আপে থাকেন তাদের আত্মহত্যার হার যারা থাকেন না তাদের চেয়ে কম।
সাইকোথেরাপি
আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাসে বেশ কিছু ধরণের সাইকথেরাপির কার্যকারিতা প্রমাণিত। সাইকোথেরাপিগুলি ভবিষ্যতে আত্মহত্যার চেষ্টা করার সম্ভাবনা কমায়।
কগনিটিভ বিহেভিওর থেরাপিঃ এই থেরাপির মাধ্যমে পীড়াদায়ক, অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং চিন্তাগুলির স্থানে যৌক্তিক বিশ্বাস স্থাপন এবং চিন্তা করতে শেখান হয়। এছাড়া যেকোনো চাপ মোকাবেলা করার কিছু কৌশল শেখান হয়।
ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিওর থেরাপিঃ এই থেরাপি একা, দলবদ্ধভাবে এবং ফোনে, এই তিন পদ্ধতির সমন্বয়ে দেয়া হয়। এই থেরাপিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল, সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর বিভিন্ন কৌশল, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি, নিজেকে প্রকাশ করার উপায়, কষ্ট এবং চাপ সহ্য করার কৌশল এবং বর্তমানে মনকে ধরে রাখার কৌশল শেখান হয়।
যাদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে, বিশেষ করে যদি তার মধ্যে মানসিক রোগ থেকে থাকে। যেমন, বিষণ্ণতা বা ব্যক্তিত্বের সমস্যার কারনে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে সেক্ষেত্রে ওষুধ দেয়া হতে পারে। ডাক্তার এবং ঝুঁকির মধ্যে থাকা ব্যক্তি একসাথে আলোচনা করে ওষুধ এবং এর সঠিক মাত্ত্রা নির্ধারণ করে থাকেন। অনেকের ক্ষেত্রে ওষুধ এবং সাইকোথেরাপি, দুটিই একসাথে ব্যবহার করা হয়।
যদি আপনাকে কোন ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে
- আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ নেয়ার সুবিধা, অসুবিধা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জেনে নিন।
- ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করে হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করবেন না। হঠাৎ করে বন্ধ করলে লক্ষণ আবার ফিরে আসতে পারে বা অধিকতর খারাপ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ অপসারণ বা প্রত্যাহারজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যপারে যেকোনো প্রশ্ন আপনার ডাক্তারকে করুন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তিনি ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন বা ওষুধ পরিবর্তন করে দিতে পারেন।
যদি কারও মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা থাকে তাহলে তার নিজের উদ্যোগগুলি নেয়া উচিত।
- নিজের সাথে আত্মহত্যা না করার অঙ্গীকার করা। যেমন আগামী এক সপ্তাহ আমি অপেক্ষা করব এবং হঠাৎ করে কিছু করে বসবোনা।
- মাদক থেকে দূরে থাকা।
- আত্মহত্যার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন ওষুধ, ছুরি, রেজর, দড়ি ইত্যাদি বাসা থেকে সরিয়ে নেয়া।
- পরিবারের লোক, বন্ধু, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক এমন কারও সাথে মনের অবস্থা নিয়ে কথা বলা।
- প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতাল বা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা।
- জিজ্ঞেস করুনঃ “আপনি কি আত্মহত্যা করার চিন্তা করছেন?” গবেষণায় দেখা গেছে এই ধরণের প্রশ্ন আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায় না বরং ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে।
- নিরাপদে রাখুনঃ আত্মহত্যার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে এমন জিনিষ যেমন ওষুধ, কীটনাশক, ধারলো বস্তু সরিয়ে রাখুন।
- তাকে সঙ্গ দিনঃ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনুন। তার আবেগ বোঝার চেষ্টা করুন।
- যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিনঃ নিকটস্থ হাসপাতাল, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সাহায্য নিতে বলুন বা যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিন।
- সম্পর্ক ধরে রাখাঃ তার সাথে যোগাযোগ ধরে রাখা এবং নিয়মিত তার খোঁজ-খবর নেয়া।
আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে, ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী পর্যায়ে এবং জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। এরকম কিছু কিছু উদ্যোগ হচ্ছে
- আত্মহত্যার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধ রাখা।
- কীটনাশক বাসার মধ্যে থাকলে তা যাতে সহজে কেউ নাগাল না পায় তা নিশ্চিত করা। যেমন তালাবন্ধ অবস্থায় তা সংরক্ষণ করা।
- মিডিয়া, সংবাদমাধ্যমে আত্মহত্যা সম্পর্কিত খবর প্রচারের সময়, এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুসরন করে প্রকাশ করা।
- মাদকের ব্যবহার কমানো।
- মানসিক রোগ, মাদক ব্যবহার ইত্যাদি দ্রুত চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা।
- অপেশাদার ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে আত্মহত্যাপ্রবণতা নিরূপণ, মূল্যায়ন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে যোগ্য করে তোলা।
- যাদের আত্মহত্যাপ্রবণতা রয়েছে তাদের ফলো আপ সেবা নিশ্চিত করা।
- আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য।
- যাদের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা রয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন না কোন মানসিক রোগে ভোগেন বা জীবনের সমস্যা এবং চাপগুলি কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা জানেননা। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন ডাক্তার বা অন্যান্য কর্মী আপনাকে এ ব্যাপারে দক্ষতার সাথে সাহায্য করতে পারবেন।
- আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসলে পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক বা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন, সাহায্য নিন।
- আশা হারাবেন না। সব সমস্যা সাময়িক। অন্ধকারের শেষে আলো আছে।
আত্মহত্যাজনিত যেকোনো সমস্যা সমাধানে আপনি সাহায্যের জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা অথবা নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন।
ডাঃ আহসান আজিজ সরকার
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট