ট্রমা হলো এক ধরনের মনোদৈহিক চাপ-জনিত ঘটনা। কোনো অনাকাঙ্খিত ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা, যা প্রত্যক্ষদর্শীর মনে ট্রমা-র সঞ্চার করতে পারে কিংবা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে এমন কোন ঘটনা থেকে পরবর্তীতে এই ট্রমা সৃষ্টি হতে পারে। একে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ বা সংক্ষেপে ‘পিটিএসডি’ বলা হয় ।
উদাহরণ স্বরূপ- শারীরিক বা যৌন নির্যাতন, মারাত্মক দুর্ঘটনা, যুদ্ধ-সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের উল্লেখ করা যেতে পারে। পিটিএসডি মানসিক রোগের পরিভাষায় উদ্বেগজনিত রোগের অন্তর্গত ।
যুক্তরাষ্ট্রের National institute of Mental health এর এক হিসাব মতে দেখা গেছে একটি নির্দিষ্ট বছরে প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হন।
ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার কয়েক মাস থেকে বছর পরবর্তী সময়ে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশেও এই হার একদম কম নয়। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী মানসিক হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। সাধারণত যে কোন বয়সের পুরূষ নারী যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন ।
অতি উত্তেজনাঃ
- ক্রমাগত উদ্বেগ
- বিরক্তি
- অনিদ্রা
- মনোযোগের অভাব
পুনঃঅভিজ্ঞতাঃ
- তীব্র অনুপ্রবেশকারী কল্পচিত্র
- ফ্ল্যাশব্যাক (অতীত ঘটনার পুনঃরোমন্থন)
- পুনঃ পীড়াদায়ক স্বপ্ন
পলায়ন প্রবণতাঃ
- পীড়াদায়ক ঘটনার রোমন্থনজনিত সমস্যা
- ঘটনা-সম্পৃক্ত স্মৃতি হতে দূরে থাকা
- বিচ্যুতি/পৃথক থাকা
- অসাড়তা (আবেগ অনুভবে অক্ষমতা)
- কাজে অনাগ্রহ
পিটিএসডি যে কোন ট্রমাজনিত কারণে হতে পারে। এটি হতে পারে এমন কোন ঘটনা যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য সংকটস্বরূপ । সাধারণত এ ধরনের ঘটনা হতে পারেঃ
- মারাত্মক দুর্ঘটনা
- সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধ-বিগ্রহ
- গুরুতর শারীরিক নিগ্রহ ( অত্যাচার, নির্যাতন, যৌন নির্যাতন)
- বন্দী অবস্থা
- সন্ত্রাসী হামলা
- প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ
- অন্য কোন প্রাণঘাতী অসুস্থতা
- ঘনঘন বিপদজনক ঘটনার সম্মুখীন হলে
- আঘাত প্রাপ্ত হলে
- অন্য কাউকে আঘাত পেতে দেখলে
- অধিক আতংকিত হলে
- মৃতদেহ দেখলে
- ট্রমার পর
- ঘটনার পর তেমন কোন সহায়তা না পেলে
- ভীত, অসহায় কিংবা তীব্র আতংকগ্রস্ত হলে
- ট্রমার পর কোন চাপজনিত ঘটনা ঘটলে ( প্রিয়জনকে হারালে, শারীরিক আঘাত বা চাকরিচ্যুত হলে )
- মানসিক রোগের অতীত ইতিহাস থাকলে
- নেশাদ্রব্য ব্যবহার করার অভ্যাস থাকলে
হ্যাঁ, শিশুদেরও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়, তবে যেহেতু তাদের শরীর ও মন বিকাশ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়, তাদের উপসর্গগুলো একেবারে বড়দের মত হয় না।
৬ বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে নিম্নের সমস্যাগুলো হতে পারে –
- টয়লেট ব্যবহার করা শেখার পারার পরও রাতে বিছানায় প্রসাব করা
- স্বাভাবিক কথা বলতে না পারা
- খেলার সময় ভয় পাওয়া এবং অস্বাভাবিক চিৎকার করা
- বাবা-মার সাথে অস্বাভাবিক সংলগ্নতা বা ঘেঁষে থাকা
আবার, কিশোর বয়সে বা বয়সন্ধিকালে ভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায় । এই বয়সীরা ধ্বংসাত্মক, প্রতিশোধপরায়ণ না আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে- বড়দের কথা অমান্য করা, ভাংচুর করা, অন্যকে আঘাত করে অনুতপ্ত না হওয়া বা আনন্দ লাভ করা।
পিটিএসডি-র চিকিৎসা মূলত একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। এর অন্তর্গত চিকিৎসা ধরণ -ওষুধ, সাইকোথেরাপি অথবা উভয় ধরনের চিকিৎসা। মূলত রোগীর সমস্যার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। এক একজন মানুষের জন্য এটি এক-একভাবে কাজ করে। তাই কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি কারো ওপর ভালো কাজ নাও করতে পা্রে। তাই একজন অভিজ্ঞ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ ।
ওষুধ ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শই একমাত্র নির্ভরযোগ্য। পিটিএসডি রোগীর বিষন্নতা, ভোঁতা অনুভূতি বা কষ্ট কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। তাছাড়া ঘুমের ব্যাঘাতজনিত সমস্যায় ভিন্ন প্রকারের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
এ ধরনের থেরাপিকে ‘স্পিচ থেরাপি’ বা ‘টক থেরাপি’ বলা হয়। রোগীকে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে ও তার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য সাধারণত ৬ থেকে ১২ সপ্তাহব্যাপী সেশনের প্রয়োজন হয়, ক্ষেত্রবিশেষে এর চাইতে অধিক সময়ও লাগতে পারে। সাইকোথেরাপি ব্যক্তি-ব্যক্তি অথবা দলগত ভাবে করা যায়। এক্ষেত্রে পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের ভূমিকাও অনেক ।
সাইকোথেরাপি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এটি সরাসরি রোগীর উপসর্গ নিয়ে কাজ করে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ বা পেশাগত সমস্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। চিকিৎসক বা থেরাপিস্ট থেরাপির ধরণ নির্বাচন করেন।
ফলপ্রসূ সাইকোথেরাপির জন্য উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। রোগীর সমস্যা সনাক্ত করে দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা এর লক্ষ্য। এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সিবিটি ( কগনিটিভ বিহেভিইয়র থেরাপি) বা চিন্তাধারা-আচরণমুলক থেরাপি।
এর অন্তর্গতঃ
এটি রোগীর ভয়কে মুখোমুখি হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ট্রমা-র ঘটনা কল্পনা করে ,লিখে বা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে এটি করা যায়। থেরাপিস্ট রোগীর অনুভূতিকে ব্যবহার করে চিকিৎসা করেন।
এই পদ্ধতিতে নেতিবাচক স্মৃতিগুলোকে পুনর্গঠন করা হয়। ট্রমা-র ঘটনাকে ভিন্নভাবে ভাবতে এটি সাহায্য করে। থেরাপিস্ট এর কাজ হচ্ছে, ট্রমা-কে বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করতে শেখানো।
এগুলো ছাড়াও আরো পদ্ধতি প্রচলিত আছে। থেরাপিস্টের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সেগুলো বাছাই করা করা যেতে পারে। মুল কথা, রোগী যেন তার নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ট্রমা-র আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন।
- এটি ট্রমা এবং তার প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে আলোচনা করে
- শিথিলায়ন ও রাগ-নিয়ন্ত্রণের উপায় শেখায়
- অধিকতর ভালো ঘুম, খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের নিয়ম শেখায়।
- রোগীকে নিজের অনুভূতি, লজ্জা বা ভুলগুলোকে চিহ্ণিত করতে সাহায্য করে।
- পিটিএসডি-র উপসর্গগুলো নিয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করে।
- চিকিৎসার উপায়গুলো নিয়ে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।
- হালকা শারীরিক কসরত, ব্যায়াম আপনার মানসিক চাপ কমাবে।
- নিজের জন্য বাস্তবধর্মী লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
- কোন বড় লক্ষ্যকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন। কাজের গুরূত্ব অনুযায়ী প্রাধান্য নির্ধারণ করুন ।
- কাছের বন্ধু, বিশ্বস্ত কেউ না নিকটাত্মীয়কে সময় দিন।
- উপসর্গগুলিকে হঠাৎ করে না কমিয়ে ধীরে ধীরে কমতে দিন।
- নিজের জন্য স্বস্তিদায়ক স্থান ও অবস্থা নির্বাচন করুন।
কী করবেন ?
- জীবন স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা
- দৈনন্দিন রুটিনে ফিরে যাওয়া
- এমন কাউকে সমস্যাগুলো খুলে বলা যাকে ভরসা করেন
- রিল্যাক্সেশন বা শিথিলায়ন ব্যায়াম
- পেশাগত কাজে ফিরে যাওয়া
- নিয়মিত খাদ্যগ্রহণ ও শারীরিক
- ট্রমার ঘটনাস্থলে ফিরে যাওয়া
- পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সাথে সমইয়
- গাড়ি চালানোর সমইয় সতর্ক থাকা কারণ মনোযোগ বিঘ্নিত হত্ব পাঁড়ে
- চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ
- ভালো কিছুর প্রত্যাশা করা। ইতিবাচক চিন্তা করা।
কী করবেন না ?
- পিটিএসডি-র উপসর্গগুলোকে নিজের দুর্বলতা মনে করা যাবে না। এগুলোকে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভাবতে হবে।
- অনুভূতিগুলিকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, পিটিএসডির চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল।
- ট্রমার ঘটনা আলোচনা করা যাবে না।
- জেনে রাখবেন –নেতিবাচক স্মৃতিগুলো সময়ের সাথে হালকা হয়ে যাবে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না ।
- নিজেকে নিয়ে অতিমাত্রায় প্রত্যাশা করা অনুচিৎ।
- অন্যদের সাথে দূরত্ব রাখা যাবে না।
- খুব বেশি ধূমপান, মদ্যপান বা কফি গ্রহণ করা যাবে না।
- অতিমাত্রায় ক্লান্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- প্রতিদিনের খাদ্যগ্রহণে কোন অনিয়ম করা যাবে না।
পিটিএসডি জনিত যে কোন সমস্যার সমাধানে আপনি সাহা্য্যের জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা – এই ঠিকানায় বা নিকটস্থ কোন হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগের জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
ধন্যবাদ।
পিটিএসডি জনিত যে কোন সমস্যার সমাধানে আপনি সাহা্য্যের জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা – এই ঠিকানায় বা নিকটস্থ কোন হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগের জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
ধন্যবাদ।
ডাঃ অমি
রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট