প্যানিক ডিসঅর্ডার বা প্যানিক রোগ একধরনের উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাক হয় যেখানে হঠাৎ করে তীব্র আতঙ্ক থেকে মৃত্যুভীতি দেখা যায়। এই রোগের কারনে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয়। সঠিক চিকিৎসা পেলে এই রোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এপিডেমিওলজি (রোগের বিস্তার)
গবেষনায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রতি হাজারে ২০-৩০ জন প্যানিক ডিসঅর্ডারে অক্রান্ত হন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে এই রোগ ২-৩ গুন হিসেবে দেখা যায়। এটি যেকোন বয়সে হতে পারে। তবে, নবীন প্রাপ্তবয়ষ্কদের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ১৪ বছরের কম এবং ৬৪ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে এটি খুবই কম দেখা যায়। প্যানিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত সাধারন মানুষের অর্ধেকের মধ্যে একই সাথে অ্যাগোরাফোবিয়া থাকে।
হঠাৎ কোন আগাম বার্তা ছাড়াই প্রচন্ড ভয়, আতঙ্ক বা অস্বস্তি শুরু হয়। কয়েক মিনিটের (সাধারণত ১০ মিনিট) মধ্যে তীব্র আকার ধারন করে। সাধারণত ৩০ মিনিট স্থায়ী হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে ১ ঘন্টার বেশিও থাকতে পারে। তীব্র আতংকের এরকম আক্রমনকে প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়। প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষনগুলো হল-
বুক ধড়ফড় করা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হৃদপিন্ড বুকের মধ্যে লাফাচ্ছে এমন মনে হওয়া
শরীর ঘেমে যাওয়া
হাঁত বা শরীর কাঁপতে থাকা
শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
দম বন্ধ হয়ে আসা
বুকে ব্যাথা বা অস্বস্তি হওয়া
বমি বমি ভাব বা পেটে অস্বস্তি হওয়া
মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা হালকা লাগা, মাথা ঘোরানো বা পড়ে যাচ্ছে এমন অনুভূতি হওয়া, জ্ঞান হারাবে এমন মনে হওয়া
প্রচন্ড গরমের বা ঠান্ডার অনুভূতি হওয়া
হাঁত-পা ঝিনঝিন করা বা অবশ হয়ে যাওয়া
সময় বা চারপাশ অবাস্তব মনে করা, নিজের শরীরের অনুভূতি বুঝতে না পারা, নিজে নিজের মধ্যে নেই এমন মনে হওয়া
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন হারানোর অনুভূতি হওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার অনুভূতি হওয়া
মরে যাওয়ার অনুভূতি হওয়া বা ভয় পাওয়া
প্যানিক ডিসঅর্ডারের রোগীদের একাধিকবার প্যানিক অ্যাটাক হয়। একবার প্যানিক অ্যাটাক হলে পরবর্তী অ্যাটাকের সময় ও পরিনতি নিয়ে সবসময় একটা ভয় বা উদ্বেগ কাজ করে। এজন্য যেসব স্থান, পরিস্থিতি বা আচরনের কারনে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে তারা সেগুলো এড়িয়ে চলেন। ফলে, তাদের মানুষের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতার (পারফর্মেন্স) অবনতি ঘটে থাকে।
প্যানিক ডিসঅর্ডারের রুগীদের মধ্যে আরোও একটি মানসিক ব্যাধি প্রচুর দেখা যায়। এর নাম অ্যাগোরাফোবিয়া। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যাক্তি যেসব স্থানে বিপদ হলে সাহায্য পাওয়া বা মুক্তি পাওয়া কঠিন মনে করেন সেসব স্থানে গেলে বা যাওয়ার কথা ভাবলে প্রচন্ড উদ্বেগ অনুভব করেন। এজন্য তারা সেসব স্থান যেমন- বাসা থেকে দূরে কোন স্থান, আবদ্ধ স্থান (লিফট, বাস, ট্রেন ইত্যাদি), ভীড় কিংবা খোলা জায়গা ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। অ্যাগোরাফোবিয়া ছাড়াও প্যানিক ডিসঅর্ডারের রুগীদের মধ্যে ডিপ্রেশন (বিষন্নতা), অন্যান্য অ্যাংজাইটি ডিসর্ডার (উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধি), পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (শূচিবাঈ রোগ), মাদকাসক্তি ইত্যাদি থাকতে পারে।
কারণসমূহ
নির্দিষ্ট কিছু বিষয় যেমন- মৃত্যুসংবাদ, আসন্ন ক্ষতি বা চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি থেকে প্যানিক অ্যাটাক শুরু হতে পারে; আবার কোন বিষয় ছাড়াও হঠাৎ করে এটি হতে পারে। এর নির্দিষ্ট কোন কারন জানা যায় নি। কিন্তু, বিভিন্ন গবেষনায় এর কারন সম্পর্কে অনেক বিষয় উঠে এসেছে।
জিনগত কারন
বিভিন্ন জিনের ত্রুটির কারনে প্যানিক ডিসঅর্ডার হয় বলে ধারনা করা হচ্ছে। পিতামাতা বা নিকটাত্মীয় কারো প্যানিক ডিসঅর্ডার থাকলে কোন ব্যক্তির প্যানিক ডিসঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।
মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্যহীনতা
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা গেছে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক পদার্থ যেমন- সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, গামা অ্যামিনো বিউটাইরিক এসিড (গাবা) ইত্যাদির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারনে প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে।
মস্তিষ্কের গঠনগত কারন
মস্তিষ্কের ভয় নিয়ন্ত্রনের সাথে সম্পর্কিত স্থান যেমন- অ্যামিগডালা, হাইপোথ্যালামাস, হিপপোক্যাম্পাস ইতাদির কর্মকান্ডের ত্রুটির কারনে প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে।
শরীরের মৃদু লক্ষনকে ভুল বিশ্লেষন করে বড় ধরনের কোন রোগ মনে করলে এর কারনে উদ্বেগ বেড়ে যায়। তখন শরীরে লক্ষনগুলো আরোও বেড়ে যায়। এভাবে একটি দুষ্টুচক্র তৈরি হয়। এটিও প্যানিক অ্যাটাকের একটি ব্যাখ্যা।
হাইপারভেন্টিলেশন
প্যানিক অ্যাটাকের সময় অনেকেই খুব ছোট ছোট করে দ্রুত শ্বাস নিয়ে থাকেন। এর ফলে শরীরে তথা মস্তিষ্কে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব কমে যায়। তারফলে পরিস্থিতি আরোও জটিল হতে থাকে।
এছাড়াও প্যানিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত অনেক রোগীর মধ্যে জীবন যাপনের সাথে সম্পর্কিত চাপদায়ক ঘটনা (সম্পর্কের টানাপোড়ন, বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর ব্যার্থতা, বড় ধরনের কোন ক্ষতি ইত্যাদি), ছোটবেলায় শারিরীক বা যৌন নিপিড়নের ইতিহাস ইত্যাদি পাওয়া যায়।
প্যানিক ডিসঅর্ডার ছাড়াও আরোও অনেক মানসিক রোগ রয়েছে যেখানে প্যানিক অ্যাটাক হয়। অনেক শারিরীক রোগেও প্যানিক অ্যাটাকের মত কিছু লক্ষন দেখা দেয়। সেজন্য, চিকিৎসা শুরু করার আগে কোন শারিরীক রোগের কারনে এটি হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখে নিতে হয়।
জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার
অ্যাগোরাফোবিয়, স্যোশাল ফোবিয়া
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার
অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (শূচিবাঈ রোগ)
শারিরীক রোগ
কার্ডিওভাস্কুলার রোগ- অ্যানজাইনা, উচ্চ রক্তচাপ, মাইট্রাল ভাল্ব প্রলাপস ইত্যাদি
পালমোনারী রোগ- অ্যাজমা, হাইপারভেন্টিলেশন ইত্যাদি
এন্ডোক্রাইন রোগ- থাইরয়েড ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির রোগ, হাইপোগ্লাইসেমিয়া ইত্যাদি
নিউরোলজিকাল রোগ- এপিলেপ্সি, স্ট্রোক ইত্যাদি
অ্যানাফাইল্যাক্সিস, ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালান্স ইত্যাদি
এছাড়া কিছু মাদকদ্রব্য ও ওষুধ যেমন- অ্যাম্ফেটামিন, মারিজুয়ানা, কোকেন ইত্যাদির বিষক্রিয়া এবং অ্যালকোহল, অ্যান্টিহাইপারটেন্সিভ ইত্যাদির উইথড্রয়ালের কারনেও প্যানিক অ্যাটাকের মত লক্ষন দেখা দেয়।
চিকিৎসা এবং থেরাপী
সাইকোথেরাপী এবং ওষুধের মাধ্যমে প্যানিক ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই ধরনের চিকিৎসা এক সাথে দেওয়া হয়।
প্যানিক ডিসঅর্ডারের রোগীকে প্রথমে আশ্বস্ত করা হয় যে এটি বড় ধরনের কোন শারিরীক রোগ নয়। এটি শুরু হওয়ার কিছুক্ষন পরেই ঠিক হয়ে যায়। রোগী এবং পরিবারের সদস্যদেরকে রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হওয়া। শারিরীক লক্ষনের ব্যাপারে রোগীকে সচেতন করে তোলা হয়। রোগ সম্পর্কে রোগীর যে ভুল ধারনা সেটি পরিবর্তনে তাকে সহায়তা করা হয়। জীবন যাপনের সাথে সম্পর্কিত কোন জটিলতা থাকলে সেটি সমাধানে তাকে সহায়তা এবং তার সামগ্রিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হয়। রোগীকে দৈনন্দিন কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
এছাড়াও এক্ষেত্রে রিলাক্সেশন টেকনিক খুবই কার্যকর চিকিৎসা। অ্যাগোরাফোবিয়া থাকলে এক্সপোজার থেরাপী দেওয়া হয়। শারিরীক ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
অনেকক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাক শুরু হওয়ার আগেই একটু অস্বস্তি লাগা শুরু হয়; বিশেষকরে যাদের আগে প্যানিক অ্যাটাকের অভিজ্ঞতা আছে তারা অনেকসময় আগে থেকেই বুঝতে পারেন যে প্যানিক অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বোঝামাত্রই শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (ব্রিদিং এক্সারসাইজ) শুরু করে দিতে হবে। তাতে করে উদ্বেগ এবং শারিরীক লক্ষনগুলোর তীব্রতা অনেকাংশেই কমে আসে। এছাড়াও মনে রাখতে হবে এবং মেনে নিতে হবে যে, সমস্যাটি কিছুক্ষন পরেই ঠিক হয়ে যাবে; এতে বড় ধরনের কোন ক্ষতি হবে না। তাছাড়াও শারিরীক লক্ষনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে যদি হাইপারভেন্টিলেশন বা খুব ছোট ছোট করে দ্রুত শ্বাস নেওয়ার প্রবনতা থাকে সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক গতিতে গভীর শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটি সম্ভবপর না হলে পেপার ব্যাগ ব্রিদিং করে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি পলিথিনের ভিতরে মুখমন্ডল রেখে হাত দিয়ে চারপাশ থেকে চেপে ধরে পলিথিনের ভিতরেই কিছুক্ষন শ্বাস নিতে হয়। এছাড়াও দ্রুত উদ্বেগ কমিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য ওষুধের সাহায্য লাগতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না।
প্যানিক ডিসঅর্ডার প্রতিরোধের ব্যাপারে তেমন কোন বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে প্যানিক অ্যাটাকের পরিমান ও ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রনে রাখা যেতে পারে। সেগুলো হল-
প্যানিক ডিসঅর্ডার ও প্যানিক অ্যাটাক সম্পর্কে ভালোভবে জানা।
নিয়মিত সুষম খাবার খাওয়া। অতিরিক্ত ক্যাফেইন সম্বৃদ্ধ খাবার যেমন- কফি, কোলা, চকোলেট ইত্যাদি পরিহার করা।
নিয়মিত শারিরীক ব্যায়াম করা।
নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, মেডিটেশন ইত্যাদি করা।
পর্যাপ্ত ঘুম পড়া।
চাপ মোকাবেলার দক্ষতা অর্জন এবং সামগ্রিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।
কোন শারিরীক বা মানসিক সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিত ওষুধ সেবন না করা।
গুরুর্তপূর্ণ তথ্যাদি
প্যানিক রোগ কোন প্রাণঘাতি ব্যাধি না।
প্যানিক অ্যাটাক দীর্ঘক্ষন স্থায়ী হয় না।
প্যানিক রোগের কারনে স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয় এবং জীবনযাত্রার মান কমে যায়।
এটি নিরাময়যোগ্য ব্যাধি।
এড়িয়ে যাবেন না, বরং মোকাবেলা করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিত ওষুধ সেবন করবেন না। ওষুধ সেবনকালে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্যানিক ডিসঅর্ডার জনিত যে কোন সমস্যায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা অথবা নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সাথে যোগাযোগ করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
ডাঃ আরিফুজ্জামান
রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট