বিষণ্ণতা রোগ
ডা. অন্তরা চৌধুরী
যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। নারীদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝঁুকি পুরুষদের দ্বিগুণ। মনে রাখা দরকার, বিষণ্ণতা রোগ ব্যক্তিগত দুর্বলতার লক্ষণ মাত্র নয়। এ রোগ স্বাভাবিক সাময়িক দুঃখবোধের চেয়ে আলাদা বিশেষ এক আবেগ—সংক্রান্ত মানসিক অসুস্থতা। তীব্রতা ভেদে বিষণ্ণতা রোগ ব্যক্তির স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করে।
উপসর্গঃ
দিনের অধিকাংশ সময় মন খারাপ বা ভার হয়ে থাকা
দৈনন্দিন কাজে আগ্রহের অভাব
আগে যেসব কাজে আনন্দ পাওয়া যেত এখন সেসবে আনন্দ বা উৎসাহ না পাওয়া
মনোযোগের অভাব
সিদ্ধান্তহীনতা
ঘুম কমে যাওয়া ( তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগীর ঘুম বেড়ে যেতে পারে)
খাওয়ায় অরুচি (তবে কিছু রোগীর খাদ্য গ্রহণ বেড়ে যায়)
ওজন কমে যাওয়া (কারো কারো ওজন বেড়ে যেতে পারে)
নেতিবাচক চিন্তা
অযৌক্তিক বা অতিরিক্ত অপরাধবোধ
অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
চিন্তা ও কাজের গতি ধীর হয়ে যাওয়া
মারাত্মক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রবণতা
উপরোক্ত উপসর্গগুলোর অধিকাংশই টানা দুই সপ্তাহের বেশী থাকলে তাকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বা গুরুতর বিষণ্ণতা রোগ বলা হয়।
বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা:
বিষণ্ণতা আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগ। গবেষকরা বলছেন, গুরুতর বিষণ্ণতা বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার—এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্তরা দিনের পর দিন অধিকাংশ সময়ই মন খারাপ করে থাকেন, কোন কাজে উৎসাহ—মনোযোগ পান না, ঘুম—খাওয়ার রুচি—উদ্যম—গতি কমে যায়। পরবর্তীতে তা তীব্র আকার ধারণ করলে আক্রান্তরা নিজেদের জীবনকে নিরর্থক ও বোঝা মনে করতে থাকেন, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন, প্রতিনিয়ত আত্মঘাতী চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হতে থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে এদের অনেকেই নির্মম সিদ্ধান্তের পরিণতি ঘটান।
চিকিৎসাঃ
বিষণ্ণতা একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ। বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা দিলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা ও চালিয়ে যাওয়া উচিত। বিষণ্ণতারোধী (অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট) ওষুধ এবং সাইকোথেরাপী— উভয় পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করা যায়। কোন রোগীর জন্য কোন ধরণের চিকিৎসা প্রয়োজন — রোগের তীব্রতা ভেদে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সে সিদ্ধান্ত নেবেন। উল্লেখ্য, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছুদিন ওষুধ সেবনের পর অথবা সাইকোথেরাপীস্টের সাথে সেশনে অংশগ্রহণের পর রোগী যখন ভাল বোধ করেন বা উপসর্গ কমে যায়, তখন রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন বা সাইকোথেরাপী সেশনে আর অংশ নেন না। ফলে, রোগীর সঠিক চিকিৎসা হয় না। এবং কিছুদিন পর রোগীর উপসর্গ আবার ফিরে আসে।
বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন,
মনকে বিষণ্ণ করে বা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে এমন কথা বা কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।
বিষণ্ণতার সময়ে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা ভালো।
সুষম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে, তবে বেশী ঘুম নয়।
সুস্থ—স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর চর্চা করতে হবে।
মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে।
রুটিনমাফিক শৃংখলাপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে।
বিষণ্ণতা ব্যক্তির কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত বা নষ্ট করে দেয় বলে তা সামগ্রিকভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উপরও বিরূপ প্রভাব
ফেলে। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য যা মোটেও সুখবর নয়। এ কারণে বিষণ্ণতা রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় শুধু ব্যক্তি ও পরিবারে নয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সচেতনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অবশ্য প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি:
ডা. অন্তরা চৌধুরী ,অনারারী মেডিকেল অফিসার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।