স্বাস্থ্য বলতে কী বুঝায়
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার
রোগ বিষয়টা যেমন সহজে বুঝা যায়, স্বাস্থ্য ধারণাটি এতো সহজকি? আপনার রোগ নেই, তাই বলেই কি বলতে পারেন আপনি স্বাস্থ্যবান? ভেবে দেখুন ব্যাপারটি এমন সহজ নয়।হয়তো বয়স অনুযায়ী আপনার যে ওজন, যে কর্মক্ষমতা থাকার কথা তা আপনার নেই । অন্যেরা আপনাকে স্বাস্থ্যবান মনে করেনা, আপনি তো নন—ই। তাহলে স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করব কিভাবে? অগত্যা বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) বর্ণিত, একটি মোটামুটি সর্বমান্য সংজ্ঞার সাহায্য নেয়া যাক।সেই মতে, অসুস্থতা বা অক্ষমতার অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয়; শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক, এই তিনদিকে পরিপূর্ণ ভাবে ভালো থাকাই হ’ল স্বাস্থ্য।সুন্দর সংজ্ঞা বটে।কিন্তু আমাদের বোধগম্যতার গোলমিটলকি ? আমার তো মনেহচ্ছে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ উঠে এল । আসলে আমরা আমাদের শরীর নিয়েই ভাবছিলাম।এখন এর মধ্য মন ও সমাজ যুক্ত হয়ে পুরো বিষয়টাকে গুবলেট পাকিয়ে দিল।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এ—সংজ্ঞাটি নিয়েও সবাই সন্তুষ্ট নন।বিশেষত যারা ‘প্রফেশনাল’, তারা এমন আদর্শিক সংজ্ঞা চান না। তারা চান এমন সংজ্ঞা, যা তা তাদের বিশেষ জ্ঞাতার সীমার মধ্যে পড়বে ।তাই তাদের মতে , রোগ বা অক্ষমতা নেই, এটাইস্বাস্থ্য।তাহলে আমরা সহজেই পরিমাপ করে বলে দিতে পারব কারো স্বাস্থ্য আছে কি নেই, এবংস্বাস্থ্য না থাকলে রোগ বা অক্ষমতার জন্য চিকিৎসাও করতে পারব। এটা নেতিবাচক অর্থ স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়ন। এ বিবেচনায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞাটি ইতিবাচক অর্থে স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়ন।বিশেষজ্ঞ দের সমালোচনায় জবাবে ইতিবাচক সংজ্ঞায়ন কারী গণ কি জবাব দেবেন ? তারা বলবেন, একজন নিরোগ হলেই আমরা সন্তুষ্ট নই। তিনি বয়স অনুযায়ী ওজন, কর্মক্ষমতা ইত্যাদি কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যা বলী ধারণ করেন কিনা, আমরা সেটা দেখতে চাই।তারা প্রশ্ন করবেন, কারো যদি মন ভালো না থাকে, তার প্রভাব তো শরীরে ও পড়ে । মন ভালো না থাকলে মানুষ পূর্ণ মাত্রায় কর্মক্ষম থাকে কি?
কারোযদিসামাজিকঅবস্থাভালোনাথাকে, তবেতিনিমানসিকভাবেভালথাকতেপারেনকি?
মানুষ হিসাবে সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে একটি ভালো সামাজিক অবস্থানে স্থিত থাকাই কি আমাদের সবার কাম্য নয়? আমার মনে হয়না, কেউ বক্তব্য টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন।কিন্তু এতে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাটি বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে গিয়ে পুরো আর্থিক—সামাজিক—রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে; কোন বিশেষজ্ঞতার সীমায় আর গণ্ডী বদ্ধ থাকে না।অথচ স্বাস্থ্য বলতে তো আমাদের এমন টিই কাম্য।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার এই পার্থক্য, মনে প্রশ্ন জাগায়, কোন বিষয়ের সংজ্ঞা কিভাবে নিধার্রিত হয় ? আমরা যে বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, তার বৈশষ্ট্যাবলী যে এর একটি নির্ণায়ক, তাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি ।আরেকট নির্ণায়ক চট করে চোখে পড়েনা ।তাহ’ল, কি উদ্দেশ্যে আমরা সংজ্ঞায়ন করতে চাচ্ছি, তা। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞায়নের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায়েনর যে পার্থক্য, তা বিষয়ের বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্দেশ্যর পার্থক্য কেই বেশী প্রতিফলিত করে।আমরা আগেই দেখেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সংজ্ঞাটির একটি রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। এজন্য এই সংজ্ঞাটি তখনই গৃহিত হতে পেরেছিল, যখন বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটা জনকল্যাণ মুখী আদর্শের প্রতি অনেকটা অনুকুল ছিল।বর্তমানে বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষে স্বাস্থ্যের এমন সংজ্ঞা প্রণয়ন সম্ভব হ’তনা। বিশ স্বাস্থ্যসংস্থা কর্তৃক স্বাস্থ্যের এ—সংজ্ঞাটি গৃহিত হয়েছিল ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা’ সম্পর্কে ‘আলমাআতাঘোষণা’—র ১ নং দফা হিসাবে। (ঘোষণা পত্রের লিঙ্কটি লেখার শেষে যুক্ত করা হয়েছে।) বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সন্মেলন, যাতৎকালীন সোভিয়েতইউনিয়নের অন্তর্গত কাজাখসোভিয়েতপ্রজাতন্ত্র—র (বর্তমানকাজাখস্থান) তৎকালীনরাজধানীআলমাআতা—তে১৯৭৮সনের৬—১২সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। নিচে ১নং ধারাটি উদ্ধৃত করলাম।এতেই ঘোষণাটির রাজনৈতিক দিকটি স্পষ্ট।
‘The Conference strongly reaffirms that health, which is a state of complete physical,
mental and social wellbeing, and not merely the absence of disease or infirmity, is a
fundamental human right and that the attainment of the highest possible level of health isa most important world-wide social goal whose realization requires the action of manyother social and economic sectors in addition to the health sector.’
মানসিকস্বাস্থ্য:
শারীরিক স্বাস্থ্য সম্বদ্ধে আমাদের কমবেশী একটি ধারণা রয়েছে । এটি অনেকটাই চাক্ষুষ, স্পর্শযোগ্য । কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য? এ —তো সরাসরি দেখা বা ছোঁয়া যায়না ।কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা তে দেখলাম মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে।শারীরিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞদের মতো মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞও রয়েছেন ।এ—ব্যাপারে তারা কি বলেন ? তাদের মতে, আমরা একজনকে তখনই মানসিকভাবে সুস্থবলব, যখন তিনি মানসিক ভাবে সুস্থ কোন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যা বলীকে ধারণ করেন।
মানসিকভাবে সুস্থব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য:
১) তারা নিজেদের সম্পর্কে ভালো অনুভব করেন।
২) তারা অন্যদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
৩) তারা জীবনের দাবী পূরণ করতে সক্ষম।
বিষয়টাকে আরেকটু বিস্তৃত করা যাক।
তারা নিজেদের সম্পর্কে ভালো অনুভব করেন মানে
তারা উদ্বেগ, ভয়, ক্রোধ, ঈর্ষা, অপরাধ বোধ, ইত্যা কার আবেগে নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলেন না।
তারা জীবনের হতাশা গুলোকে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারেন।
নিজেদের ও অন্যদের প্রতিতাদের এটা সহিষ্ণুও সহজ মনোভাব থাকে এবং তারা নিজেদের সবকিছু সহজে গ্রহণ করতে পারেন।
তারা তাদের ক্ষমতাকে ছোট বা বড় করে দেখেন না। তারা তাদের অক্ষম তাকে মেনে নেন। তারা আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন মানুষ।
তারা বিভিন্ন অবস্থার সাথে মানিয়ে চলতে পারেন। তারা সাধারণ ও নৈমিত্তিক বিষয় থেকে আনন্দ লাভ করেন। তারা অন্যদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন মানে তারা অপরকে ভালবাসেন এবং অন্যের স্বার্থ কে বিবেচনা করেন।
তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলো তৃপ্তি কর ও টেকসই। তারা অন্যদের পছন্দ এবং বিশ্বাস করেন। অন্যরা ও তাদের পছন্দ ও বিশ্বাস করবে বলে আস্থা রাখেন।
তারা মনুষে মানুষে বিদ্যমান স্বকীয় পার্থক্য গুলিকে সম্মান করেন তারা অপরের ভাল মানুষির সুযোগ নেননা এবং নিজেদের ভালো মানুষিকে অন্যের দ্বারা ব্যবহারের সুযোগ দেন না। তারা নিজেদের নিজ নিজ গোষ্ঠী বা সমাজের একটা অংশ বলে গণ্য করেন তারা আশেপাশের মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে বলে অনুভব করেন। তারা জীবনের দাবী পূরণ করতে সক্ষম মানে
তারা তাদের পরিবেশ কে সাধ্যমত গড়ে নেন অথবা প্রয়োজন অনুসারে পরিবেশের সাথে খা খাইয়ে চলেন। তারা আগাম পরিকল্পনা করেন এবং অনাগত ভবিষ্যত কে ভয় পান না। তারা নতুন অভিজ্ঞতা ও ধারণাকে স্বাগত জানান তারা তাদের মেধা কে কাজে লাগান।তারা নিজেদের জন্য বাস্তব সম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। তারা তাদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। কর্ম সাধনে সাধ্য মত চেষ্টা করার মাধ্যমে তারা সন্তুষ্টি লাভ করেন।
সামাজিকস্বাস্থ্য:
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোন মানসিক রোগ না থাকাটাই মানসিক স্বাস্থ্য নয়।এখানে আরেক টি বিষয় লক্ষ্য যোগ্য, মানসিক সুস্থতার বৈশিষ্ট্যা বলী নির্ণীয় হয়েছে কোন ব্যক্তি কে কেন্দ্র করে ।এ বর্ণনায় সামাজিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটি আসেনি । যদি ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী সামাজিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ । এখনো সামাজিক স্বাস্থ্যের ধারণা টি তে মন দানা বাঁধেনি; সম্ভবত সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য কোন বিশেষজ্ঞ শ্রেণি গড়ে উঠেনি বলে।মনেহয়, আর্থ—সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরকে ব্যাপ্তকারী এ—ধারণাটির জন্য কোন বিশেষজ্ঞ শ্রেণি তৈরী হওয়াটা আপাতত সম্ভব নয়।আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে এই সামাজিক স্বাস্থ্যটি এ তো অতপ্রোত জড়িত যে, বাস্তব কাজের বেলা আমরা একে পুরো উপেক্ষা করতে পারিনা । রোগীর আর্থ—সামাজিক অবস্থার খোঁজ খবর আমাদের নিতেই হয়। কিন্তু বিষয়টি সুষ্ঠ ভাবে তত্ত¡ায়িত হয় না বলে আমাদের প্রয়োগে (প্র্যাকটিসে) বিষয়টি পরিপূর্ণ মাত্রায় উঠে আসেনা। ফলে আমাদের প্রয়োগ খণ্ডিত থাকে । সামাজিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করার বিষয়টি যেহেতু শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আওতার বাইরে, তাই তারা এতে মনোযোগী হন না এবং ক্রমে তা সচেতনতা ও তত্ত¡ায়নের বাইরে পড়েযায়।স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মরত সবার জন্য তাই সামাজিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনথাকা, অবহিত থাকাটা জরুরী প্রয়োজন।
উপসংহার:
তাহলে স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টহল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা টি বিশেষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের জন্যকে জোনা হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসাবে আমাদের জন্য একটি আদর্শিক মানদণ্ড।মানুষ হিসাবে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পরিপূর্ণ ভালো থাকাটাই আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়া।সমাজ ও রাষ্ট্র কে সে লক্ষ্য কে সামনে রেখেই অগ্রসর হতে হবে।
আলমাআতা ঘোষণার লিঙ্ক:https://www.who.int/publications/almaata_declaration_en.pdf
লেখকপরিচিতি:
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ।
প্রকাশিতবই: ‘সামাজিক চেতনারমনস্তত্ত¡’, ‘এপিকুরসআধুনিকতাওআমরা’, ‘শতবর্ষেদেবীপ্রসাদ’, ‘সিগমুন্ডফ্রয়েডএবংঅফ্রয়েডীয়ফ্রয়েডবাদীগণ’।সবগুলোবইয়েরপ্রকাশক, সংহতিপ্রকাশন, ঢাকা।
ইমেইল: bidhanranjan@gmail.com