শরীর ও মন পরস্পর অবিচ্ছেদ্য অংশ
ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
একই ব্যক্তির শরীর আর মন – ব্যক্তির সামগ্রিকতার নির্দেশক। একজন মানুষকে পরিপূর্ণ বর্ণনা করতে হলে যেমন শরীর ও মন উভয়েরই বর্ণনা করতে হবে, তেমনি কোনো ব্যক্তিকে বুঝতে হলে তার শরীর-মন উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। শরীর আর মনের এই সংযোগ যে অবিচ্ছেদ্য, তা যেমন আমরা কোনো রোগ হলে বুঝতে পারি। তেমনি স্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ-এর ক্ষেত্রেও এটি বুঝতে পারা যায়।
যেমন ধরা যাক, উদ্বেগের কথা। উদ্বেগ মানুষের একটি স্বাভাবিক আবেগ। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে উদ্বেগ না হওয়া-ই বরং অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করে। আবার এই উদ্বেগ অতিমাত্রায় হলে তা রোগের পর্যায়েও পড়তে পারে। উদ্বেগের প্রকাশ শারীরিক-মানসিক দু-ভাবেই হয়। স্বাভাবিক উদ্বেগ-এ যেমন এসব উপসর্গ দেখা দেয়, তেমনি উদ্বেগজনিত রোগ, অথবা যেসব রোগে উদ্বেগ একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য – সেখানেও এই উপসর্গগুলো দেখা দেয়। রোগের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
উদ্বেগ নানা ধরণের শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এবং এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে রয়েছে অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম বা স্ব-ক্রিয় ¯œায়ু তন্ত্রের কারসাজি। এই ¯œায়ুতন্ত্রের ক্রিয়ায় উদ্বেগের প্রকাশ ঘটে হৃৎপিন্ড ও রক্তসংবহন তন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র -এর নানা কার্যাবলীর পরিবর্তনের মাধ্যমে।
উদ্বিগ্ন অবস্থায় হৃৎস্পন্দনের হার বা নাড়ির গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, শরীরে রক্ত সরবরাহের ধরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। বুকে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয় বা বুক ধড়ফড় করে। উদ্বেগে লালাগ্রন্থির রস ও হজম-রসের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে, ব্যক্তির মুখ বা জিভ শুকিয়ে যায়, খাওয়ার রুচি কমে যায়, ঢোক বা কোনো কিছু গিলতে কষ্ট হয়, পেট ফাঁপা বা পেটে অতিরিক্ত গ্যাস অনুভূত হয়, পেটের উপরিভাগে অস্বস্তি লাগে, বার বার অথবা পাতলা পায়খানা হয়। উদ্বিগ্ন অবস্থায় শ্বাস প্রশ্বাসের হার বেড়ে যেতে পারে। শ্বাস নিতে কষ্ট বোধ হওয়া, দম আটকে আসা, অগভীর বা অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস – প্রভৃতিও দেখা যায়। উদ্বেগে অনেকের ঘন ঘন প্র¯্রাবের বেগ পায়। মহিলাদের মাসিকের ক্ষেত্রে অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। যৌন মিলনের সময় পুরুষাঙ্গের উত্থানে ব্যর্থতা দেখা দেয়। মাথা ঘোরানো, মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাড়ে ব্যথা, বেশী ঘাম, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা প্রভৃতি।
উদ্বেগ-এর মানসিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যত সম্পর্কে ভীতিকর আশংকা, নেতিবাচক চিন্তা, ভুলে যাওয়া, অমনোযোগিতা, একই ভাবনার পুনরাবৃত্তি, অস্থিরতা, শব্দ বা আলোতে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা প্রভৃতি। এছাড়া উদ্বেগে ঘুম কমে যায়, দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ। রোগের ক্ষেত্রেও শরীর-মনের অবিচ্ছেদ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় অসংখ্য। দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার এবং ঝুঁকি নিরোগ মানুষের চেয়ে বেশী। রোগ ভেদে এ ঝুঁকি দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত। শারীরিক রোগের সাথে মানসিক রোগও নির্ণীত হলে অনেক ক্ষেত্রেই এদের মধ্যে সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ একটি রোগের কারণে অন্য রোগটি হয়। হতে পারে, মানসিক রোগের কারণে শারীরিক রোগ হয়েছে, কিন্তু শারীরিক রোগটি ধরা পড়েছে আগে, মানসিক রোগটি জানা গেছে পরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে পঞ্চাশ বছর বয়সী ব্যবসায়ী তারিক শামস-এর কথা, যিনি অ্যালকোহলে আসক্ত কিন্তু পরিবার বা ঘনিষ্ঠ কেউ সে কথা জানে না। অ্যালকোহল বা মদে আসক্তির ফলাফল স্বরূপ তার লিভার সিরোসিস হলো। শারীরিক উপসর্গ-লক্ষণ দেখে পরীক্ষার মাধ্যমে তার লিভার বা যকৃতের রোগটি আগে ধরা পড়ল। পরবর্তীতে এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল তার দ্রব্য ব্যবহার রোগের কথা। বলা যেতে পারে বিশ বছর বয়সী মডেল অরুণার কথাও। তরুণী কম ওজন এবং অপুষ্টিজনিত শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে নির্ণীত হয় যে তিনি স্বল্পাহার-জনিত কৃশতা বা ‘অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা’ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত, যার ফলশ্রæতিতে দেখা দিয়েছে শারীরিক জটিলতা।
উল্টোভাবে, শারীরিক রোগের কারণেও হতে পারে মানসিক রোগ। শারীরিক রোগ, এর জটিলতা এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রভাব – যে কোনো ভাবে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। ষাট বছর বয়সী গৃহবধূ মনিরা রহমান দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানী রোগে আক্রান্ত এবং এ রোগের চিকিৎসায় টানা অনেকদিন স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ নিচ্ছেন। কিছুদিন ধরে তার ভেতর সন্দেহপ্রবণতা, ভ্রান্ত বিশ্বাস, গায়েবী আওয়াজ শোনা প্রভৃতি মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে জীবনে প্রথম বারের মতো। দীর্ঘদিন নেয়া স্টেরয়েড ‘সাইকোসিস’ জাতীয় মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে। শারীরিক রোগের সরাসরি মস্তিষ্কে প্রভাব ছাড়াও এর মানসিক ও সামাজিক প্রভাবেও হতে পারে মানসিক রোগ। দীর্ঘমেয়াদী কোনো শারীরিক রোগ ও এর চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ‘সাইকোলজিক্যাল’ বা মানসিক প্রভাব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী একটি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওষুধ সেবন করতে হতে পারে আজীবন। কেবল ওষুধ সেবন-ই নয়, রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রণালীতেও আনতে হয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া ব্যক্তির জন্য মানসিক চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিরাময়যোগ্য নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে রোগটি মেনে নেয়া এবং এর বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াও ব্যক্তির মানসিক শক্তির বড় পরীক্ষা নেয়। ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির মাঝেই বিষণœতা রোগ দেখা দেয়। একইভাবে, ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝেও মানসিক রোগের ঝুঁকি নিরোগ মানুষের চেয়ে বেশী। দীর্ঘমেয়াদী যেসব রোগে কষ্টদায়ক উপসর্গ যেমন, তীব্র ব্যথা, ঘন ঘন বমি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি থাকে এবং রোগীর কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায় বা রোগী চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন, সেসব ক্ষেত্রে মানসিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে। শারীরিক কিছু রোগের কারণে কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় বা না থাকায় অনেকেই চাকরিচ্যুত বা কর্মহীন হয়ে পড়েন। বেকারত্ব মানসিক রোগের অন্যতম বড় একটি প্রভাবক।
শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে যেসব মানসিক রোগ বেশী দেখা দেয়, সেগুলো হচ্ছে – অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেশন বা বিষণœতা রোগ, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত রোগ। এছাড়াও রোগীদের অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা তীব্র মানসিক চাপজনিত রোগ, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ, মাদকাসক্তি বা দ্রব্য ব্যবহার-জনিত রোগ, ঘুমের সমস্যা-জনিত রোগ, সেক্সুয়াল ডিজঅর্ডার বা যৌন রোগ ইত্যাদি রোগও হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে সামগ্রিকভাবেই মানসিক রোগকে গুরুত্ব কম দেয়া হয়। একই ঘটনা ঘটে শারীরিক রোগে আক্রান্তদের মানসিক সমস্যার বেলাতেও। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর শারীরিক রোগটি যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়, মানসিক রোগটিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু সহ-ঘটমান মানসিক রোগ শারীরিক রোগটির চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। মানসিক রোগটির চিকিৎসা না করালে শারীরিক রোগের চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে এবং রোগীর জীবনীশক্তিও হ্রাস পায়। রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে জীবনাশংকাও তৈরী করে।এসব কারণে, শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক রোগের পাশাপাশি কোনো মানসিক সমস্যা বা রোগ আছে বা হচ্ছে কি না তা মূল্যায়ন করতে হবে এবং মানসিক রোগ ধরা পড়লে দ্রæত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।